ডেঙ্গু একটি মশকবাহিত রোগ। স্ত্রী এডিস মশা যদি কোনো ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে দংশন করে, তাহলে ওই মশার দংশনের মাধ্যমে অন্য সুস্থ ব্যক্তিও ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে পারে। এডিস মশার আয়ুষ্কাল ১০ থেকে ১২ দিন, তবে এদের ডিম ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে ওই ডিম থেকে মশা জন্মাতে পারে।
যদিও ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব হয় আফ্রিকা মহাদেশে, তবে ভাইরাসটি এখন বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ মানুষ ডেঙ্গুর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
প্রতিবছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ২২ হাজার মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে ১৯৬০ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগী চিহ্নিত হয় এবং ২০০০ সালে রোগটি মহামারি আকার ধারণ করে। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ আছে। এগুলো হচ্ছে ডিইএনভি-১, ডিইএনভি-২, ডিইএনভি-৩ ও ডিইএনভি-৪।
আইইডিসিআরের গবেষণা অনুযায়ী ২০১৬ সালের আগে ডিইএনভি-১ ও ডিইএনভি-২ দ্বারা মহামারি সংঘটিত হয়, তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে অন্য দুটি সেরোটাইপ, ডিইএনভি-৩ ও ডিইএনভি-৪ শনাক্ত হয়নি। ২০১৭ সালে ডিইএনভি-৩ প্রথম শনাক্ত হয় এবং ২০১৮ সালে ডিইএনভি-৩ সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। ২০১৯ সালে এটি মহামারি আকার ধারণ করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ সালে প্রায় এক লাখ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় এবং আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ২০ জনের মৃত্যু হয়।
এতে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার চিকিৎসা ব্যয় হয়। ২০২০ ও ২০২১ সালে ডিইএনভি-৩-এর প্রাধান্য থাকলেও ২০২২ সালে ডিইএনভি-৩ ও ডিইএনভি-৪-এর সংক্রমণ লক্ষ করা যায়।
ভাইরাসটির জিনোমের একটি মাত্র ওপেন রিডিং ফ্রেম থেকে তিনটি স্ট্রাকচারাল প্রোটিন সি, এ, ই এবং সাতটি নন-স্ট্রাকচারাল প্রোটিন এনএস১, এনএস ২এ, এনএস২বি, এনএস৩, এনএস৪বি, জিইএন, এনএস৫ তৈরি হয়। ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের মধ্যে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ অ্যামিনো এসিড সিকোয়েন্স মিল আছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশে আবার ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটলে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) ডেঙ্গু ভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স করে। সিকোয়েন্সকৃত ২১টি নমুনায়ই ডিইএনভি-৩ সেরোটাইপ পাওয়া যায়।
ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণের ফলে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে, তবে বেশির ভাগ লোকের কোনো উপসর্গ দেখা যায় না বা রোগের হালকা লক্ষণ থাকে। প্রায় ৫ শতাংশ লোকের ক্ষেত্রে রোগটি প্রকট হতে পারে, এমনকি প্রাণঘাতীও হতে পারে। রোগের প্রকটতা ভাইরাসের সেরোটাইপ, আক্রান্ত ব্যক্তির ইমিউন অবস্থা, ব্যক্তির কো-মোরবিডিটি এবং ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্টের ওপর নির্ভর করে। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপের যেকোনোটি দ্বারা প্রথমবার আক্রান্ত হলে সাধারণত উপসর্গবিহীন অথবা মৃদু উপসর্গ দেখা যেতে পারে। কিন্তু যখন দ্বিতীয়বার ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস আক্রমণ করে, তখন তা মারাত্মক ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার অথবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রূপ নিতে পারে, যা থেকে মৃত্যুও হতে পারে। অন্যান্য ভাইরাসের ক্ষেত্রে যেখানে প্রথমবার ইনফেকশনের কারণে আমাদের শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা ভবিষ্যতে একই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও তাই হয়, তবে শুধু একই সেরোটাইপ দ্বারা আক্রান্ত হলে কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে না, বরং হাইপার ইমিউন রি-অ্যাকশন দেয়, কারণ ভিন্ন সেরোটাইপের ক্ষেত্রে ভাইরাসকে মানব শরীর অ্যান্টিজেন হিসেবে নিয়ে অ্যান্টিজেন অ্যান্টিবডি কমপ্লেক্স গঠন করে, যা অ্যান্টিজেন প্রেজেন্টিং সেল (APC) যেমন ম্যাক্রফেজের কাছে উপস্থাপন করে। কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের অ্যান্টিবডি হওয়ায় তা ভাইরাসকে সম্পূর্ণরূপে প্রশমিত করতে পারে না। ফলে APC -এর মধ্যে Degranulation বা ক্ষতিকর প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিভিন্ন ধরনের সাইটোকাইন নির্গত হতে থাকে, যা প্লাজমা লিকেজ ও সাইটোকাইন স্ট্রোম সৃষ্টি করতে সাহায্য করে।
মানুষের রক্তে অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্তকণিকা, যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। সুস্থ মানুষের প্লাটিলেটের স্বাভাবিক সংখ্যা রক্তে প্রতি ঘন মিলিলিটারে দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ। ডেঙ্গু বা অন্য রোগেও প্লাটিলেট কমতে পারে। তবে এক লাখের নিচে এলে জটিল হয়।
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর প্লাটিলেট সামান্য কমলেও এক লাখের বেশি থাকে। সাধারণ ডেঙ্গু আর ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের মধ্যে পার্থক্য আছে। শুধু জ্বর বা রক্তক্ষরণ হলেই সেটা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলতে হলে প্লাটিলেট এক লাখের নিচে থাকতে হবে। সেই সঙ্গে রক্তের হেমাটোক্রিট ২০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ থাকতে হবে। সঙ্গে থাকতে পারে রক্তনালি থেকে রক্তরস বেরিয়ে আসা বা প্লাজমা লিকেজের সমস্যা। যেমন—প্রোটিন কমে যাওয়া, পেটে ও বুকে পানি জমা। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষের ডেঙ্গু হয়, এর মধ্যে খুব কমসংখ্যক হেমোরেজিক ডেঙ্গু হয়। ডেঙ্গু হলে রক্তের CBC (Complete Blood Count) পরীক্ষার মাধ্যমে প্লাটিলেট সংখ্যা জানা যায়। আসলে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় সিবিসি পরীক্ষা দ্বারা শুধু হেমোরেজিক কি না তা জানা যায়।
৮৯-৯০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কমে বটে, তবে এদের মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশের জটিল পর্যায়ে যায়। মোট ৫ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর মারাত্মক রক্তক্ষরণ জটিলতা হয় আর রক্ত দেওয়ার দরকার হয়। প্লাটিলেট সংখ্যা ২০ হাজারের নিচে নামলে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে। প্লাটিলেট যদি পাঁচ হাজারের কম হয়, তখন মস্তিষ্ক, কিডনি, হৃৎপিণ্ডের মধ্যে রক্তক্ষরণের ভয় থাকে। তবে ডেঙ্গু যে রক্তক্ষরণের কারণ, তা শুধু প্লাটিলেট কম নয়, আরো ১১টি কারণ আছে। এ জন্য অনেক দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে নামলে প্লাটিলেট সঞ্চালন করার পরামর্শ দেয়। ডেঙ্গু রোগের আসল চিকিৎসা প্লাটিলেট সঞ্চালন নয়, বরং নিখুঁতভাবে পানিশূন্যতা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, প্লাজমা লিকেজ বা প্লাজমা যেন রক্তনালির বাইরে চলে না আসে তা দেখা। রক্তক্ষরণের জন্য ডেঙ্গু রোগী সাধারণত মারা যায় না, বরং বেশির ভাগ মৃত্যু ঘটে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের কারণে। রোগী যখন শকে চলে যায়, তখন হৃত্স্পন্দন দুর্বল হয়, রক্তচাপ নেমে যায়, শরীরের বিভিন্ন অপরিহার্য অঙ্গের রক্ত সঞ্চালন কম হয়।
অনেক সময় প্লাটিলেট পরীক্ষা করে দুশ্চিন্তা বাড়ে, আবার মেশিনে প্লাটিলেট গুনলে এই সংখ্যা ভুল হতে পারে, কারণ প্লাটিলেট ক্লাম্প বা গুচ্ছ হিসেবে থাকায় মেশিন অনেকগুলোকে একটা হিসাবে গণনা করে। সাধারণত ডেঙ্গু রোগীকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও যথেষ্ট তরল খাবার খেতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করে স্যালাইন দিতে হবে। তা ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা নেই। বেশির ভাগ এমনি এমনি সেরে যায়।
লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)